রাহাত এই মুহূর্তে বসে আছে মাউন্ট এডোরা হাসপাতালে। কি করে মায়াকে নিয়ে এই হসপিটাল পর্যন্ত এসেছে রাহাত নিজেও তা জানে না। মাইক্রো বাসটা রাহাতের দিকে তেড়ে আসায় মায়া রাহাতকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেও নিজে টাল সামলাতে না পেরে পড়ে যায়। তাও একেবারে রাস্তার আইলানের উপরে মাথাটা বেশ জোরে ধাক্কা লাগে মায়ার। রক্ত পড়তে থাকে কপালের বাম দিকটা থেকে। হসপিটালও বেশ অনেকটা দূর এগিয়ে পেয়েছে রাহাত। ততক্ষণে হাতের রুমাল দিয়ে মায়ার মাথাটা চেপে ধরে থাকলেও বেশ অনেকটাই রক্ত বেরিয়ে গেছে। ডাক্তাররাও জরুরিভাবে চিকিৎসার ব্যবস্থা করছে। ড্রসিং করে দেয়ার পরও তেমন সুবিধা না বুঝে মায়াকে এ্যাম্বুলেন্সে করে পাঠানোর ব্যবস্থা হচ্ছে। রাহাত ফ্যালফ্যাল করে সব দেখছে। কি করবে কি বলবো কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
এ্যাম্বুলেন্সেও মায়ার হাতটা ধরে ঠায় বসে ছিল রাহাত। গাড়িটা সিলেটে হাসপাতালের সামনে পড়ে আছে। ঢামেকে নেয়ার পর পরই ডাক্তাররা তড়িঘড়ি করে চিকিৎসা শুরু করে দিলো। ঘন্টাখানেক পর অপারেশন থিয়েটার থেকে ডাক্তার বের হচ্ছে দেখে রাহাতের হুঁশ ফিরলো। ডাক্তারের দিকে এগিয়ে গেল রাহাত কাঁপা পায়ে। কি শুনতে হতে পারে সেটা ভেবেই বুকটা মুচড়ে উঠছে বারবার। তবু ডাক্তারের হাসি মুখটা দেখে একটু ভরসা পাচ্ছে কেন জানি।
-মিস্টার রাহাত?? রাইট? ইউর ওয়াইফ ইজ আউট অফ ডেন্জার নাউ।
-মায়ার সাথে দেখা করা যাবে ডক্টর প্লিজ?
-উনাকে কেবিনে দেয়া হবে একটু পর। তারপর যাবেন। আর হ্যাঁ।।বেশ কিছুদিন ধরে সম্ভবত খাওয়ারের অনিয়ম করেছিলেন ম্যাডাম। প্রেশার সাংঘাতিক রকমের ফল করেছে। ব্লাডের সাথে সাথে স্যালাইনও চলছে। ঘুমেরও দরকার উনার৷ তাই বেশিক্ষণ থাকবেন না। প্লিজ।
-জি ডক্টর।
মায়াকে কেবিনে দেয়ার পর রাহাত মায়ার বিছানার পাশে গিয়ে বসলো। মাথায় ব্যান্ডেজ, হাতে স্যালইন আর ব্লাডের নল লাগানো। নিজেকে প্রচন্ড রকমের অসহায় লাগছে রাহাতের। কেন জানি মনে হচ্ছে ওর পাপের শাস্তি মেয়েটা পাচ্ছে। ডাক্তার যদিও বলছে সপ্তাহ খানেকের মধ্যেই মায়া সুস্থ হয়ে যাবে। তবুও রাহাতের সবটা অসহ্য লাগছে। এভাবে মায়াকে চুপ করে থাকতে দেখে, এভাবে নিথর হয়ে শুয়ে থাকতে দেখে মোটেও ভালো লাগছে না রাহাতের। নার্স এসে জানালো আর থাকা যাবে না। রাহাত তাই মায়ার কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। কি করবে এখন!? কি ভেবেছিল আর কি হলো!! রাতে মায়ার কথায় বেরিয়ে আসলেও আবার বাড়িতে ফিরে আসছিল রাহাত৷ মেয়েটার রাগটা না বেঠিক নয়। রাহাত অন্যায় যখন করেছে সেটার মাশুল তো দিতেই হবে৷ আর এরকম একটু আধটু কথা তে মায়া তাকে শোনাতেই পারে৷ তাই মায়ার কাছে ফিরতে ফিরতে প্ল্যানিং করছিল রাহাত৷ বাড়ি ফেরার কি সারপ্রাইজ দেয়া যায় এসবই প্ল্যানিং করছিল। এর মধ্যে কি থেকে কি ঘটে গেল!!?
রাহাত মিহানের নাম্বারে কল করে মায়ার এক্সিডেন্টের কথাটা জানালো। মিহান। মা, দিয়া আর আজীজ সাহেব সবাই আধা ঘন্টার মাঝেই হাসপাতালে পৌঁছে গেল। রাহাতের বাবা ছাড়া সবাই রাহাতকে এটা ওটা বলে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করতে লাগলো। আজীজ সাহেব শুধু ছেলের সাথে একটাও কথা বললেন না। ডাক্তারের চেম্বারে চলে গেলেন কথা বলতে৷
আরো আধা ঘণ্টা মতো পরে মায়ার হুঁশ ফিরলো৷ সবাই একে একে দেখা করে এলো। রাহাত যাচ্ছে না দেখে মিহান টেনে রাহাতকে মায়ার মাথার কাছে বসিয়ে দিয়ে সবাইকে নিয়ে কেবিন থেকে বেরিয়ে এলো। মায়া স্যালাইন লাগানো হাতটা রাহাতের হাতের উপরে রাখলো।
-মায়া?? আম সরি।
-সরি কেন বলছ?? আর এমন কাঁদছ কেন? রাহাত? এই??
-আমার জন্য তোমার যদি কিছু হয়ে যেত!?
-ভয় পেয়ে গেছ? ভেবেছ মরে টরে যাই কিনা?
-মায়া?
-আরে? আমি তো এমনি বললাম, মরে গেলে সত্যি সত্যি বিয়ে করো মিষ্টি একটা মেয়ে দেখে। কেমন??
-মাইর দিবো ধরে। আজাইরা কথা বলো কেন সবসময়??
- আমার এই অবস্থায়ও তুমি মারবে আমাকে?!?
-এই না না। সরি মায়াবতী?? সরি সরি?
-হি হি। এখন যাও তো।৷ বাসায় যাও। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে তারপর আসো। সারা রাত এভাবে কাটিয়েছ রক্ত টক্ত গায়ে লেগে আছে। ছি....
-যত নাটকই করো তোমাকে রেখে এক পা ও নড়ছি না আমি।
-এখন তো হসপিটালে আমি। তার উপরে এই অবস্থা। কোথাও চলে যাবো না। নিশ্চিতে যাও।
-মায়া?
-যাও না? শাওয়ার নিবা? খাবা। আমার জন্য মায়ের কলাপাতা রঙা জামদানি শাড়িটা নিয়ে আসবা আসার সময়। হসপিটালের ড্রেস পড়বো না। শাড়ি পড়বো।
-উঠতে পারবে না সে নাকি শাড়ি পড়বে।।
-তুমি পড়িয়ে দিও প্লিজ?? যাও না এখন। উফ।
-মায়া? কি হয়েছে? খারাপ লাগছে? ডাক্তারকে ডাকবো??
-এতো কথা বলাচ্ছো তুমি। আমার কথা শুনছই না। জানো না রোগীর কথা শুনতে হয়?-আচ্ছা বাবা! যাচ্ছি।
মায়ার আলতো করে মায়ার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বেরিয়ে এলো রুম থেকে। মায়ার মাকে মায়ার কেবিনে রেখে বাসায় ফিরলো রাহাত। মিহান দিয়াও রাহাতের সাথে বাড়িতে ফিরলো। মায়ার জন্য রান্না করে দিবে রাহাতের কাছে। রাহাতের অনেক অনুরোধের পর মিহানরাও রাহাতদের বাড়িতে উঠেছে। সিলেট থেকে আসার সময় ড্রাইভার উনাদেরকে রাহাতদের বাড়িতেই নিয়ে গিয়েছে। এই দুদিন মিহান, দিয়া আর মা তাই ওখানেই থাকছে।
বাসায় এসে রাহাত তড়িঘড়ি করে শাওয়ার নিলো। টিশার্টটায় মায়ার রক্ত লেগে আছে। সেটা ধুয়ে শুকাতে দিয়ে রেডি হয়ে নিলো রাহাত৷ তারপর মায়ার জন্য শাড়িটা নিতে আলমারি খুললো। অনেকক্ষণ খোঁজাখুঁজির পরে শাড়িটা পেল রাহাত৷ শাড়িটা নিতেই আরেকটা শাড়িও নিচে পড়ে গেল। শাড়িটা তুলেই হা হয়ে গেল রাহাত। সিলভার কালারের সুতোর কাজ জর্জেটের একটা শাড়ি। এই শাড়িটা মায়ার আলমারিতে কি করে এলো কিছুই বুঝলো না রাহাত। শাড়িটার কথা মনে হতেই কয়েকটা হার্ট বিট যেন মিস হয়ে গেল রাহাতের। এই শাড়িটা তো সেই মেয়েটার পড়নে ছিল সে দিন রাতে। মেয়েটাকে খুঁজতে খুঁজতে কত না বাজে পরিস্থিতিতে জড়িয়ে গেছে রাহাত!! আর সেই শাড়ি মায়ার কাছে! কি করে!! শাড়িটা আরেকটু ভালো করে দেখতেই রাহাতের চোখ পড়লো শাড়ির আঁচলের দিকে খানিকটা ছেঁড়া অংশের দিকে। সেদিন রাতে কি ঘটেছিল!! আর শাড়িটাই বা ছিঁড়লো কি করে!! কিছুই মাথায় আসছে না রাহাতের।
শাড়িটা ধলা পাকিয়ে আলমারিতে রাখবে এমন সময় শক্ত কিছুতে হাত ঠেকলো রাহাতের। জিনিসটা বের করে চমকে উঠলো রাহাত৷ নীল রঙা একটা ডায়েরি। ডায়েরিটার প্রথম পেইজটা উল্টাতেই রাহাত আর মায়ার বিয়ের একটা ছবি। রাহাত আলতো করে ছবিটা ছুঁয়ে দিয়ে ডায়েরিটা নিয়ে খাটে বসে পড়লো। ডায়েরিটায় অনেক লেখা আছে। মায়া ডায়েরিতে কি এতো লিখেছে ভিষণ জানতে ইচ্ছে করছে রাহাতের।
প্রথম পেইজে মায়ার বাবা মারা যাওয়ার পর ঢাকায় আসার ঘটনা। তারপর রাহাতের বাবার সাথে পরিচয়, রাহাতের পি.এ হওয়ার ঘটনা, জুলি, দ্বীপ, রাহাতের প্রপোজ সব একে একে লেখা। রাহাত মায়ার লেখাগুলো পড়ে কখনো হাসছে, কখনো অবাক হচ্ছে। একটা পেইজে গিয়ে থমকে গেল রাহাত। বছর খানেক আগের ডেইট দেয়া পেইজটায়। লেখাগুলো কয়েকবার পড়লো রাহাত। পড়ে থমকে রইলো।"জানো? তোমার প্রজেক্টের কাজটা এতোদিন পর নতুন করে শুরু করবে শুনে ভিষণ খুশি লাগছিলো। বাবাকেও রাজি করিয়েছি প্রজেক্টে ফাইনান্স করার জন্য। সবই ঠিক ছিল। কিন্তু ঝামেলা হলো জুলিকে নিয়ে। ওই মেয়েটা কেন তোমার প্রজেক্টে কাজ করবে!? ভিষণ খারাপ লেগেছিল জানো!? বড্ড রাগ হয়েছিল তোমার উপরেও। তুমি কি জানো না মেয়েটা কতো খারাপ? ও শুধু তোমার সম্পত্তির লোভে তোমাকে কাছে টানে বুঝো না কেন তুমি?
ইদানিং বিজনেস পার্টি, ক্লাব, প্রজেক্ট এসব নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেছ ভিষণ৷ তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। কিন্তু সেখানেও এই মেয়েটা কেন!?
ওই মেয়েটা আমাকে কল করেছিল রাতে। তুমি নাকি ওর সাথে রাত কাটাবা। শুনেই মাথাটা পুরো ব্ল্যাঙ্ক হয়ে গেছে জানো?? ড্রাইভার চাচা যখন তোমাকে ছাড়াই ফিরলো তখন নিজেকে আরো বেশি অসহায় লাগছিলো। বারবার মনে হচ্ছিল তোমার মুখে না শুনে কিছুতেই বিশ্বাস করবো না। তাই তো এতো রাতেও ড্রাইভারকে নিয়ে জুলির ফ্ল্যাটে ছুটে গিয়েছিলাম৷ মেয়েটাও নির্লজ্জের মতো দরজা খুলে দিয়ে দেখালো তুমি বিছানায় শুয়ে আছো। তখন ইচ্ছে করছিল মেয়েটাকে খুন করে ফেলি। তুমি শুধু আমার। তোমার ভাগ আমি কাউকে দিবো না। মেরে ফেলবো একদম। "
এতোটুকু পড়েই রাহাতের সারা শরীরটা যেন কাঁপানি দিয়ে উঠলো। এতো সব হয়েছিল কখন! আর মায়াই বা কোন দিনের কথা বলছে! কিছুই মনে নেই রাহাতের। পরে কি হলো পড়ার জন্য পেইজটা উল্টালো রাহাত। কি হয়েছে সেটা জানা তার অনেক জরুরি।
"রাহাত, জানো?
জুলি মেয়েটার বিছানায় তোমাকে শুয়ে থাকতে দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। তবু তোমার বন্ধ চোখ জোড়া দেখে মনে হয়েছিল তোমাকে মেয়েটা ফাঁসিয়েছে বা তোমার হয়তো কোন দোষই নেই। মেয়েটাকে কয়টা থাপ্পড় লাগিয়ে ড্রাইভার আর আমি তোমাকে ধরে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসালাম। তারপর সোজা বাসায়। তখনও হুঁশে ছিলে না তুমি। কি সব যেন বলছিলে বিড়বিড় করে। বুঝতেও পারিনি। জানো? রুমে আসতেই তুমি আমাকে জাপটে ধরেছিলে। কেমন একটা ঘোর কাজ করছিল যেন তোমার মাঝে। জানো তুমি? এর আগে কখনো তুমি এতো গভীরভাবে ভালোবাসো নি। তোমার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম যেন৷ আর জানো? কতোটা পাগলামি করেছ কাল তুমি? আমার সাধের শাড়িটা সেইফিপিনের সাথে টান লেগে অনেকটা ছিঁড়েও ফেলেছ। অনেকটা কাছে পেয়েছিলাম জানো তোমাকে? একসময় তুমি পাগলামি করতে করতেই আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েও পড়লে। তখন হাসবো কি কাঁদবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
জুলি মেয়েটার বিছানায় তোমাকে শুয়ে থাকতে দেখে মরে যেতে ইচ্ছে করছিল আমার। তবু তোমার বন্ধ চোখ জোড়া দেখে মনে হয়েছিল তোমাকে মেয়েটা ফাঁসিয়েছে বা তোমার হয়তো কোন দোষই নেই। মেয়েটাকে কয়টা থাপ্পড় লাগিয়ে ড্রাইভার আর আমি তোমাকে ধরে ধরে গাড়িতে নিয়ে বসালাম। তারপর সোজা বাসায়। তখনও হুঁশে ছিলে না তুমি। কি সব যেন বলছিলে বিড়বিড় করে। বুঝতেও পারিনি। জানো? রুমে আসতেই তুমি আমাকে জাপটে ধরেছিলে। কেমন একটা ঘোর কাজ করছিল যেন তোমার মাঝে। জানো তুমি? এর আগে কখনো তুমি এতো গভীরভাবে ভালোবাসো নি। তোমার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছিলাম যেন৷ আর জানো? কতোটা পাগলামি করেছ কাল তুমি? আমার সাধের শাড়িটা সেইফিপিনের সাথে টান লেগে অনেকটা ছিঁড়েও ফেলেছ। অনেকটা কাছে পেয়েছিলাম জানো তোমাকে? একসময় তুমি পাগলামি করতে করতেই আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমিয়েও পড়লে। তখন হাসবো কি কাঁদবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
অবশ্য পরের দিন সকালে বেশ বেলা করে তোমার ঘুম ভাঙলো। দেখে মনে হলো তোমার কিছুই মনে নেই। আমিও আর কিছু বলিও নি। জিজ্ঞেসও করি নি। কি জিজ্ঞেস করবো বলো?"
রাহাত পুরো থতমত খেয়ে গেল লেখাটা পড়ে৷ সেদিনের সেই মেয়েটা তাহলে আর কেউ নয় মায়া ছিল!! শিট!! নিজের গাধামির জন্য নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে রাহাতের। কয়েকটা পেইজ উল্টাতে আরো কিছু লেখা আছে ডায়েরিতে।
"জানো??আজ আমাদের সেকেন্ড মেরেজ এনিভার্সারি। তোমার মনে নেই এবারও। অবশ্য সেটা নিয়ে আমার কোন মাথাব্যথা নেই। কিন্তু গত দুটো দিন বাসায়ও ফিরলে না? কেন?? এতোই ব্যস্ত?? জানো? আজ আমি তোমার জন্য তোমার দেয়া গিফ্টটায় নিজেকে সাজিয়েছিলাম, পুরো ঘরটা তোমার পছন্দমতো সাজিয়েছি মোমের আলোয়। সবই আছে শুধু তুমি নেই। ভিষণ কান্না পাচ্ছে জানো?"
"সকালে ঘুম ছুটতেই দেখলাম বিছানাটা খালি। তুমি আজও বাসায় ফিরলে না৷ প্রথমে ভাবলাম হয়তো কাজে ব্যস্ত তুমি। কিন্তু একটা মেসেজ আমার সমস্ত ভুল ভেঙে দিলো। মেসেজটা জুলির। তুমি গত দুদিন নাকি তুমি ওর সাথেই। জানো আজ তোমাকে অবিশ্বাস করতে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু জানো তো? বিশ্বাস বলো আর অন্ধবিশ্বাস বলো সবটারই একটা সীমা থাকে। হয়তো আমার সেই সীমাটা শেষ হয়ে গেছে। তাই চলে যাচ্ছি। তোমার পথের বাঁধা হতে চাই না। তাই মুক্তির ব্যবস্থা করে গেলাম৷ পারলে ক্ষমা করে দিও প্লিজ। "
এর পরে আর লেখা নেই। মায়া ডায়েরিটা রেখেই চলে গিয়েছিল সেদিন। দূরত্ব ব্যাপারটা কতোটা ভুল বোঝাবুঝি তৈরি করতে পারে সেটা ভালোই টের পাচ্ছে রাহাত। সেদিন পার্টিতে ড্রিংকস করার পর কি হয়েছিল একদমই মনে নেই রাহাতের। তবে এটা বেশ বুঝতে পারছে জুলি ইচ্ছে করেই ওদের মাঝে ভুল বোঝাবুঝি করানোর চেষ্টা করেছে এবং সফলও হয়েছে। জুলির সাথে তো সে মোটেও ছিল না। ভুল করেছিল ঠিক। তবে সবটা মায়াকে না বললে মেয়েটা আরো কষ্ট পাবে, হয়তো আরো ভুলও বুঝবে।
ডায়েরি রেখে কলাপাতা রঙা জামদানি শাড়িটা নিয়ে হাসপাতালে ছুটলো রাহাত। মায়া বাসায় ফিরলে সবটা বুঝিয়ে বলতে হবে ওকে। আর কেউ যেন ওদের মাঝে সন্দেহ ঢোকাতে না পারে এবার সেটাই করবে রাহাত। আর জুলিকেও ও দেখে নিবে।
সাতটা দিন মায়াকে হাসপাতালে একেবারে চোখে চোখে রেখেছে রাহাত। সময় মতো ওষুধ খাইয়ে দিয়েছে৷ কপালের ব্যান্ডেজ খোলার পর মলম লাগিয়ে দিয়েছে কপালে, চুল ধুয়ে দিয়েছে, চুলে তেল লাগিয়ে চুল আঁচড়ে দিয়েছে। সকালে ঘুম ভাঙা থেকে রাতে ঘুমানো পর্যন্ত প্রত্যেকটা কাজে হেল্প করেছে মায়াকে ও। রাহাতের সেবায় হোক বা সবার দোয়ায় মা খুব তাড়াতাড়িই সুস্থ হয়ে উঠেছে৷ কপালটা আরেকবার ড্রেসিং করে দিয়ে তাই মায়াকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে দেয়া হলো। তাই রাহাত মায়াকে নিয়ে খুশি মনে বাসায় ফিরলো। মায়াবতীটাকে আর কিছুতেইরাগ করে থাকতে দিবে না রাহাত।
মায়াকে নিয়ে বাসায় ফিরলো রাহাত। সবার সাথে একটু কথা বলে মায়া রুমে চলে গেল। রাহাত একটু পরে রুমে এসে মায়াকে দেখে থমকে গেল। মায়ার মোবাইলটা নিচে মায়ার সামনেই পড়ে আছে। মায়াও ফ্লোরে বসে আছে৷ চোখ মুখ ফুলে লাল হয়ে গেছে। রাহাত বুঝতেই পারছে না এই কয়েকটা মিনিটের মধ্যে কি এমন হলো যে মেয়েটা এভাবে পাগলের মতো হয়ে গেছে!?! রাহাত একটু এগিয়ে এসে মায়ার সামনে বসে মুখটা তুলে ধরার চেষ্টা করলো। মায়াও প্রায় সাথে সাথে রাহাতের কাছ থেকে ছিটকে দূরে সরে গেল।
-মায়া?? এই মায়াবতী? কি হলো??
-খবরদার এই নোংরা হাত দিয়ে আমাকে তুমি ছোঁবে না একদম৷
-আরে?? এই মায়া?? কি বলছো এসব? আমি আবার কি করেছি!??
-কি করেছ জানো না তুমি? জানো না কি করেছ!!? দাঁড়াও, দেখাচ্ছি।
মায়া নিচে থেকে মোবাইলটা হাতে নিয়ে রাহাতের দিকে দেখালো। রাহাত মোবাইলটা হাতে নিয়ে দেখলো। চারটা ভিডিও পাঠানো হয়েছে জুলির নাম্বার থেকে। রাহাত আবার মায়ার দিকে তাকালো।।
-মায়া? আই ক্যান এক্সপ্লেইন।
-কি ব্যাখ্যা দিবে তুমি?? ঘরে বউ থাকার পরও কেন তুমি অন্য কোন মেয়ের কাছে যাবে? আমি কি এতোটাই অক্ষম রাহাত? এতোটাই যে তোমার সাথে অন্য কারো বিছানার.....ভিডিও দেখতে হবে!!
-মায়া?? সেরকম কিচ্ছু হয় নি।
-কি বলতে চাও তুমি??! এক একটা ভিডিওতে যে তোমার কয়েক ঘন্টার নোংরা রূপটা ফুটে উঠেছে, তার সবটাই মিথ্যে!!??
রাহাত আর কিছু না বলে চোয়াল শক্ত করে মায়ার মোবাইলের সাথে টিভির কানেক্ট করলো। তারপর মায়াকে টেনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে টিভি অন করে ভিডিও প্লে করলো৷ মায়া মুখ ঘুরিয়ে নিতে চাইলেই রাহাত মায়ার গাল শক্ত করে চেপে ধরে টিভি সেটের দিকে ফেরালো।
-মায়া?? সবটা যখন জেনেই গেছ তখন পুরোটা জানা উচিত তাই না? কি বলো??
-ছাড়ো আমাকে রাহাত। আমি দেখবো না।
-দেখতে তো তোকে হবেই। আমি এতো ময়না-তোতা করে তোকে বোঝালাম। তুই বুঝলি না। জুলির উপরেই তোর সব ভরসা না? হ্যাঁ আমি মানছি আমি এসব করেছি। সব করেছি। ডজন খানেক মেয়ের সাথে ফিজিক্যালি ইনভলভড হয়েছি। এখানে তো শুধু কয়টাই আছে। এগুলোই দেখ আগে। মন ভরে দেখ।
-ছাড়ো রাহাত,লাগছে আমার।
-লাগুক। এই প্রত্যেকটা ভিডিও এখন তুই দেখবি। আমার সামনে দেখবি। তারপর যা বলবি আমি শুনবো। তার আগে না। এর পর যদি তুই চলে যেতেও চাস আমি আটকাবো না তোকে।
-রাহাত??
-কি রাহাত?? তুমি জানতে চাইছিলে না তোমার অক্ষমতা টা কি?? সেটাই দেখো মন দিয়ে। জুলির সাথে ভিডিওটা বেশি হট। ওটা সবগুলোর শেষে দেখো। ওকে?? প্লে করছি।
রাহাত মায়াকে শক্ত করে চেপে ধরে ভিডিও প্লে করলো। মায়া না পারছে ছুটতে না পারছে সরে যেতে। রাহাত চিবুক শক্ত করে মায়াকে দেখছে। ভিডিওতে একটা মেয়ে রাহাতের দিকে এগিয়ে আসছে দেখে মায়া চোখ বুজে নিলো।
-মায়া? চোখ খুলো??
-পারবো না আমি। কিছুতেই না।
-মায়া? চোখ খুলতে বলছি তোকে। আমাকে আর রাগাস না ভালোয় ভালোয় বলছি।।
আমি কতটা নিচ, কতোটা নোংরা, চরিত্রহীন--তার প্রত্যেকটা জিনিস তোকে আজ দেখতেই হবে--। তারপর যা হবার হবে। চোখ খোল মায়া।।
মায়া চোখ শক্ত করে বুজে রইলো। আর চোখের কোণা দিয়ে পানি ঝরছে। রাহাত সেদিকে পাত্তা না দিয়ে ভিডিওর ভলিউম বাড়িয়ে দিলো। মায়ারও তো সবটা জানা উচিত। এভাবে লুকোচুরি খেলা আর কতো!!!
চলবে..........
পরের পর্বে গল্প শেষ!
পরের পর্বে গল্প শেষ!

মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন